অনলাইন ডেস্ক: নবী-রাসুলগণের ওয়াজ-নসিহতের পদ্ধতি মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম মডেল। তাঁরা নিজেদের জীবনের প্রতিটি দিকেই ছিলেন সত্য, সুন্দরের প্রতিনিধি। তাঁদের ওয়াজের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, সঠিক পথের দিশা দেওয়া এবং মানবজাতির অন্তরে তাকওয়া ও আখলাক গড়ে তোলা। বর্তমান সময়ের ওয়াজের সঙ্গে তাঁদের পদ্ধতির তুলনা করলে অনেক পার্থক্য বোঝা যায়। নবী-রাসুলগণ তাঁদের নিজস্ব মতামত বা চিন্তা থেকে কোনো কথা বলতেন না। তাঁরা কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহি নাজিল হতো, সেটিই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনিই সেই মহান প্রভু, যিনি উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তাদের পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন’ (সুরা জুমা : ২)। এটাই তাদের দাওয়াত ও তাবলিগের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করত।
নবী-রাসুলগণ সবসময় সহজ ও বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করার মতো। তাঁরা এমন ভাষা ব্যবহার করতেন যা তাঁদের শ্রোতাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তাঁদের দাওয়াত কখনো কঠোর বা বিরূপ হতো না। তাঁরা বিনম্রভাবে এবং মমতা দিয়ে কথা বলতেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনকে দাওয়াত দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তোমরা তার সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলো, সম্ভবত সে স্মরণ করবে বা আল্লাহকে ভয় করবে’ (সুরা তোহা : ৪৪)। এই নীতি অনুসরণ করে নবী-রাসুলগণ সর্বদা নরম হৃদয় এবং ধৈর্যশীলতার সঙ্গে মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করতেন।
দাওয়াত দেওয়ার ধরন বিভিন্ন পরিস্থিতি, জাতি এবং সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ছিল। পবিত্র কুরআনে হজরত নুহ, হুদ, সালেহ এবং শুয়াইব, মুসা, ঈসা, যাকারিয়া (আ.) প্রমুখ অনেক নবী-রাসুলের দাওয়াত প্রদানের ঘটনা আলোচিত হয়েছে। হজরত নুহ (আ.) ছিলেন মানবজাতির প্রথম রাসুল, যাকে তাঁর জাতির শিরক ও পাপ থেকে মুক্তির জন্য পাঠানো হয়েছিল। তিনি তাঁর জাতিকে ৯৫০ বছর ধরে আল্লাহর পথে আহ্বান করতেন। তিনি দিনের বেলায়, রাতের অন্ধকারে, প্রকাশ্যে এবং একান্তে সব পরিস্থিতিতে দাওয়াত দিয়েছেন। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলতেন, ‘আমি আমার জাতিকে দিনরাত আহ্বান করেছি’ (সুরা নুহ : ৫)। মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের ক্ষেত্রে আরেকজন নবীর কথা কুরআনে বারবার আলোচিত হয়েছে। তিনি হজরত মুসা (আ.)। তিনি ফেরাউন ও তার অনুসারীদের আল্লাহর পথে ডাকার দায়িত্ব পান। তাঁর দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ। ফেরাউনের মতো কাফিরের দরবারেও আল্লাহ নম্র ভাষায় দাওয়াত দেওয়ার আদেশ করেছিলেন।
হজরত হুদ (আ.)-কে আদ জাতির মধ্যে প্রেরণ করা হয়েছিল। আদ জাতি ছিল শক্তিশালী, সমৃদ্ধিশালী এবং উচ্চ কৌলীন্যের অধিকারী। তবে তারা অহংকারী ছিল এবং শিরকের পথে চলে। হুদ (আ.) তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান। হুদ (আ.) বলেছিলেন, ‘হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো; তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো উপাস্য নেই’ (সুরা হুদ : ৫০)। আদ জাতি তাদের ক্ষমতা ও স্থাপত্যকলা নিয়ে অহংকার করত। হুদ (আ.) তাদেরকে সতর্ক করেন, আল্লাহর অবাধ্য হলে তাদের শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘তোমরা শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে অহংকার করো না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো’ (সুরা হুদ : ৫২)। সব নবীর দাওয়াতের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের জীবনকে শিরক, কুসংস্কার এবং পাপমুক্ত করা। তবে প্রত্যেক নবীর দাওয়াতের পদ্ধতি তাঁদের জাতির প্রয়োজন ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত ছিল। ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতা ছিল তাঁদের দাওয়াতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নবীগণের ওয়াজ-নসিহতের পদ্ধতি আজও আমাদের জন্য অনুকরণীয় এবং প্রাসঙ্গিক।
Leave a Reply