1. shahjahanbiswas74@gmail.com : Shahjahan Biswas : Shahjahan Biswas
  2. ssexpressit@gmail.com : sonarbanglanews :
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৫ অপরাহ্ন

ডিজিটাল প্রতারক চক্র সক্রিয় পদে পদে প্রতারণার ফাঁদ

  • সর্বশেষ আপডেট : শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৭৯ বার পড়েছেন

অনলাইন ডেস্ক: মো. মজিবুর রহমান (৫০) একজন চাল ব্যবসায়ী। সম্প্রতি তার ইমো অ্যাপ থেকে অন্যান্য ব্যবসায়ী ও স্বজনদের মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে বলা হয় ‘আমার বিশেষ প্রয়োজনে ২০ হাজার টাকা লাগবে’। ‘দিলে অনেক উপকার হবে। আমি সামনের সপ্তাহে দিয়ে দেব’।

একইভাবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনোয়ার মাস্টার নামে একজন গণমাধ্যর্মীর ইমো আইডি থেকে প্রায় একই এসএমএস আসে। শুধু ইমো বা হোয়াটস-অ্যাপ নয়, প্রতারকরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস-এমএফএস প্রতিষ্ঠানের অ্যাপে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

গত ১৬ মাসে এ ধরনের ডিজিটাল প্রতারণার ৬৮ মামলা ও ৮৮টি সাধারণ ডায়েরি তদন্ত করেছে কেবল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেফতার করা হয়েছে ৬৩ আসামিকে। এ ছাড়াও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আরও অনেকে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন প্রতিদিন গড়ে আড়াই  হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেনের মাধ্যম মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে ঘিরে সক্রিয় রয়েছে অসংখ্য ডিজিটাল প্রতারক চক্র। প্রথমে ভুক্তভোগীদের মানসিক চাপে ফেলে এরপর তারা এমএফএস প্রতিষ্ঠানের অ্যাপে ইচ্ছেমতো নম্বর বসিয়ে প্রতারণা করে আসছে।

ভুক্তভোগীদের ওই নম্বরের মালিক এমএফএসের গ্রাহক কি না, তা যাচাই করতেই এ প্রচেষ্টা। গ্রাহক হলেই ওই নম্বরে এমএফএস প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সেজে ফোন করে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে প্রতারক। ফাঁদে পা দিলেই কখনো গাণিতিক ধাঁধায় ফেলে, কখনো গ্রাহকের গোপন তথ্য জানিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি সংগ্রহ করে হাতিয়ে নেয় অ্যাকাউন্টের সব টাকা।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ সময়ের আলোকে জানান, প্রতারকরা গ্রাহকের নম্বর যাচাই করতে নিয়োগ করে একজন অ্যাপসম্যান। ওই নম্বরে ফোন করে কৌশলে ওটিপি সংগ্রহ করে ওয়েলকামম্যান। আর টাকাগুলো দূরের জেলায় পরিচিতজনের কাছে পাঠিয়ে দেয় ক্যাশম্যান। ওই টাকা সংগ্রহ করে ভাগবাটোয়ারা করার দায়িত্ব ক্যাশ রোলিং ম্যানের। পুরো কাজটা সারতে সহযোগিতা করে আরও দুয়েকজন। পরিকল্পিতভাবে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই এ কাজ করে আসছে। শিক্ষাজীবনে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও প্রতারণার কৌশল তারা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার পুলিশ সেন্টার) মো. রেজাউল মাসুদ সময়ের আলোকে বলেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। পাশাপাশি এর অযৌক্তিক ব্যবহারও বেড়েছে। তিনি বলেন, সিআইডির সাইবার ক্রাইমে প্রতারণার যেসব অভিযোগ আসে তার ৯০ শতাংশ ডিজিটাল প্রতারণা।

তিনি বলেন, এসব প্রতারকের খপ্পরে বেশি পড়েন গ্রামের অর্ধশিক্ষিত নারীরা। গ্রামের নারীদের উদাসীনতার সুযোগ নেয় প্রতারকরা। এই সুযোগে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর। এরপর থেকেই সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট কানেকশন। দেখা যায় ইন্টারনেট অপব্যবহার করছে শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক, পূর্ণবয়স্ক, মধ্যবয়স্ক, বয়োবৃদ্ধ-এক কথায় সবাই। এ অবস্থায় প্রযুক্তিগত দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে ডিজিটাল প্রতারক চক্র। প্রতারণার শিকারদের বেশিরভাগই মামলা করতে না চাওয়ায় এ সংক্রান্ত অপরাধের প্রকৃত তথ্যও জানা যায় না। প্রতারণা থেকে মুক্তির জন্য আইনের প্রয়োগের চেয়ে নাগরিকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বেশি দরকার বলে তিনি মনে করেন। আসলে ইন্টারনেট সিকিউরিটি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, একসময় প্রতারণার ধরন ছিল সাধারণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারক চক্র বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে শিক্ষিত শ্রেণিও ব্যাপকভাবে ডিজিটাল প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়া, হতাশা ও অসৎসঙ্গ বেশি দায়ী।

তিনি বলেন, সমাজ থেকে প্রতারণা চিরতরে বন্ধ হবে না। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও সময়োপযোগী উদ্যোগের ফলে মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।

গত ২৭ মার্চ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিচয় দিয়ে এবং নকল বিল-ভাউচার পাঠিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কোরবান আলী সিকদার নামে একজনকে গ্রেফতার করে ডিবি দক্ষিণ বিভাগের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম। কোরবান আলী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার ই-মেইল আইডি, টেলিফোন নম্বর ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে স্মার্ট সলিউশন নামে প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে ব্যাংকগুলোতে বার্ষিক সিসি ক্যামেরা সার্ভিস এবং প্রিন্টার টোনার সরবরাহ বাবদ নকল বিল ভাউচার তৈরি করে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার অফিসিয়াল ই-মেইল করতেন। পরে আসামি নিজেই ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করে মেইল চেক করে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলতেন। এভাবেই কোরবান আলী প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

গত ২৬ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি থেকে ডলার বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে জাকির হোসেন (৩৫) নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ)। ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্লক করে দেওয়ার ঘটনায় রাজধানীর মতিঝিল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন একজন ফ্রিল্যান্সার।

জাকির প্রতারণার উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অর্ধশতাধিক আইডি ব্যবহার করতেন। এসব আইডি ব্যবহার করে ডলার বিক্রির পোস্ট দিতেন। সম্প্রতি এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে ডলার দেওয়ার কথা বলে ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাকে ব্লক করে দেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রতারণার শিকার হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এই প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন জাকির।

এ ছাড়ার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কর্মকর্তাসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে। ওই চক্রের মূল হোতা চীনা নাগরিক কেভিন চেন (৪০) পলাতক। এই চীনা নাগরিক দেশের কয়েকজন তরুণের সহযোগিতায় ভুয়া মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলারও প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।

এ ছাড়াও গত বছরের ২০ অক্টোবর নওগাঁর পত্নীতলা থেকে ডেটিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নারী সেজে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চক্রের আট সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ১০টি স্মার্ট ফোন, ২৫টি সিম, ৫টি মেমোরি কার্ড ও ২টি ক্রেডিট কার্ডসহ বিভিন্ন জিনিস উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব জানিয়েছে, প্রতারকরা ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন ডেটিং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে অবৈধভাবে ডলার লেনদেনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। মোবাইলে অবৈধভাবে বিভিন্ন অ্যাপ এবং গ্রুপের মাধ্যমে ডলার গ্রহণ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করত।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে প্রতারণার বেশিরভাগই হচ্ছে ডিজিটাল প্রতারণা। প্রতারকরা অনলাইনে এখন জমি কেনাবেচা থেকে শুরু করে শাড়ি, কাপড়, গহনা, প্রসাধনী প্রায় সবকিছুই কেনাবেচা করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, সমবায়ের নামে বা এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণাও অনেক বেশি। যেমন ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অনলাইননির্ভর ছিল। তাদের আমরা আইনের আওতায় এনেছি। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কিছু না বুঝেই প্রতারকদের পাঠানো লিংকে প্রবেশ করেই ফাঁদে পড়েন। এখন দিন যত যাচ্ছে ডিজিটাল প্রতারকরা তত বেশি সক্রিয় হচ্ছে। আমরাও কাজ করে তাদের গ্রেফতার করছি।

খবরটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন :