অনলাইন ডেস্ক: রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগ। সোমবার সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১০ মিনিট। এ ১০ মিনিটে ১৩ জন রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসক। প্রতিজন রোগী দেখতে কর্তব্যরত চিকিৎসক সময় নেন ৪৬ সেকেন্ড। এরপর তিনি নাস্তার জন্য বিরতি নেন। চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করা কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, রোগের লক্ষণ শুনেই ওষুধ লিখে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগের জন্য প্যারাসিটামল ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার চিত্র প্রায় একই রকম।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রোগীপ্রতি মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন ডাক্তাররা। এ বিষয়ে ৬৭টি দেশের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, রোগীপ্রতি সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অবস্থান সবার নিচে। রোগীর প্রতি অবহেলা এবং তার ফলে ভুল চিকিৎসার করুণ চিত্র প্রতিবেদনটিতে ফুটে ওঠে।
গ্রাম থেকে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন শেখ রমজান আলী। এলাকার অনেক ডাক্তারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, সুস্থ হননি। একসময় ঢাকায় এসে ডাক্তার দেখানোর পরে তার মূল অভিযোগ, এখানে ডাক্তাররা সময়ই দিতে চান না। সমস্যার কথাগুলোই মন দিয়ে শোনেন না, সমাধান দেবেন কী!
বাংলাদেশি ডাক্তারদের নিয়ে রোগীদের প্রধান অভিযোগ, তারা সময় নিয়ে রোগীর সমস্যার কথা শোনেন না। তাহলে সমাধান কী দেবেন? অপচিকিৎসায় কঠোর কোনো শাস্তির নজিরও এ দেশে নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে আমাদের দেশে চিকিৎসকদের পেশাদারত্বে ঘাটতি, অন্যদিকে চিকিৎসাসেবা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। আছে চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যও। এ কারণে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা খরচ মেটাতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে অবশ্যই রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় ও হয়রানি অনেকাংশে কমে যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের দেশের প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ সেবা ও মানবিকতা ভুলে কেবলই বাণিজ্য করছে, যা অনৈতিক। রোগীদের আগেই জানিয়ে দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় না, ভোগান্তিতেও পড়তে হয় না। এখন ডিজিটাল যুগ, তাই সবাইকে একটা সিস্টেমের মধ্যে আনা উচিত।
তিনি বলেন, এমবিবিএস ডাক্তার কিংবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের দেখা পাওয়া যায়। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের বেশি ওষুধ সেবনের অত্যধিক প্রবণতা। সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবার অর্থই কেবল ওষুধ সেবন। ওষুধের চাহিদা বেশি থাকায় দেশের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো লাখ লাখ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে। ফলে জনগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করছে, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সসহ জনস্বাস্থ্যকে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তাই যেকোনো মূল্যে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে একেবারে যে কাজ হয়নি তা নয়। কিছু অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আর বেশি হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হয়নি। কারণ সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক। মানুষ বেশি। সবাই কথা বেশি বলে; কিন্তু বাস্তবায়ন তেমন নেই। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত রয়েছে। তাদের দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। করোনাও আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এ জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করাসহ ওষুধের দামও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
Leave a Reply