অনলাইন ডেস্ক: আজ ১০ ডিসেম্বর। বিএনপির আলোচিত গণসমাবেশের দিন। ঢাকায় সমাবেশ ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মাসের শুরু থেকে ১৫ দিনের জন্য সারা দেশে শুরু হয় পুলিশের বিশেষ অভিযান। শুক্রবার বিকালে সমাবেশের জায়গা গোলাপবাগ মাঠ ঠিক হওয়ার পর সমাবেশস্থলসহ পুরো রাজধানীতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
রাজধানীর প্রতিটি প্রবেশপথ ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও অলি-গলিতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন র্যাব-পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। কোনো যাত্রী বা পথচারীদের সন্দেহ হলেই আটক করা হচ্ছে। পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপও চেক করতে দেখা গেছে।
যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা রোধে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো ধরনের হামলার আগাম শঙ্কা না থাকলেও সমাবেশ ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ।
ডিবিপ্রধান বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায় বলে আমাদের জানিয়েছে। সমাবেশ ঘিরে আমরাও সিকিউরিটি প্ল্যান তৈরি করেছি। আমরা মনে করি না, কোনো ধরনের হামলার শঙ্কা আছে। তারপরও আমাদের পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ প্রস্তুত রেখেছি। সমাবেশস্থল ঘিরে সাদা পোশাকে আমাদের পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য দায়িত্বে থাকবে। বিভিন্ন ভবনের ছাদেও তারা অবস্থান করবে।
নয়াপল্টনে অতিরিক্ত পুলিশ : বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর থেকেই নয়াপল্টন এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শুক্রবারও কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ ছিল। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও তালাবদ্ধ। নয়াপল্টন এলাকায় ঢুকতে গেলে তল্লাশি করছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও পুলিশের তল্লাশির মধ্য দিয়ে ভেতরে যেতে হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর প্রায় অর্ধশত লোক ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে নয়াপল্টন কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। পুলিশের বেষ্টনী পেরোনোর চেষ্টা করলে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করতে দেখা গেছে।
মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপ চেক : সরেজমিনকালে দেখা গেছে, পল্টন এলাকায় মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জার চেক করছিলেন পুলিশ সদস্যরা। কাউকে সন্দেহ হলে এমনটি করা হচ্ছিল। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবুল হাসান বলেন, উপর থেকে নির্দেশনা থাকায় এলাকায় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এলাকায় বসবাসরত বা যৌক্তিক কারণ হলে ঢুকতে দিচ্ছি। পুলিশ সদস্যরা কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে চেক করছেন।
আবদুল্লাহপুরে তল্লাশি : ঢাকার প্রবেশমুখ আবদুল্লাহপুর মোড়ে যাত্রীবাহী বাস, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদর তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা গেছে। শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আবদুল্লাপুর মোড়ের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের মাথায় অবস্থান করে এই তল্লাশি করে পুলিশ।
গাবতলীতে সতর্ক পুলিশ : ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ গাবতলীর পর্বত চেক পয়েন্টে চলে পুলিশের তল্লাশি। ঢাকার বাইরে থেকে আসা বাসগুলো থামিয়ে ভেতরে তল্লাশি চালানো হয়। সন্দেহজনক কোনো কিছু পেলে তা পরীক্ষা করে দেখেন পুলিশ সদস্যরা। কুষ্টিয়া থেকে আসা এসবি সুপার ডিলাক্স বাসের সহকারী মোজাফফর হোসেন বলেন, আসার পথে তিন-চার জায়গায় তল্লাশি হয়েছে। তবে আমাদের বাস থেকে কিছু পাওয়া যায়নি।
যাত্রবাড়ী, সায়েদাবাদ, ডেমরায় তল্লাশি : আরেক প্রবেশপথ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করে পুলিশ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মৌচাক, মদনপুর, মেঘনা টোল প্লাজার সামনে চারটি পুলিশ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সাইনবোর্ড চেকপোস্টে সকাল থেকেই গাড়ি থামিয়ে ও পথচারীদের তল্লাশি করতে দেখা গেছে। আবার ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চেক পোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করতে দেখা গেছে।
সাইনবোর্ড মোড়ে ফেনী থেকে ঢাকায় আসা স্টার লাইনের যাত্রী আবদুল কুদ্দুস বলেন, ঢাকা আসার পথে গাড়িটি চার জায়গায় তল্লাশি করেছে। পুলিশ গাড়ি থামালে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্টার লাইন পরিবহনের হেলপার নাম প্রকাশ না করে বলেন, বন্ধের দিনগুলোতে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকলেও অর্ধেকের কম যাত্রী নিয়ে ঢাকায় এসেছেন।
সাইনবোর্ড চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করা ডিএমপির ডেমরা জোনের প্যাট্রোল ইন্সপেক্টর নুরুল ইসলাম মল্লিক বলেন, এ মহাসড়কে পুলিশের অনেক চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা সব সময় প্রস্তুত। সাধারণত ঢাকায় প্রবেশের সময় গাড়ি বা ব্যাগসহ যাত্রীদের তল্লাশি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারের কয়েকজন কর্মী বলেন, শুক্রবার ও শনিবারের ছুটিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার বহু চাকরিজীবীসহ নানা পেশার মানুষ ঢাকায় আসে ও ছাড়ে। কিন্তু ১০ তারিখের সমাবেশের কারণে যাত্রীদের ভেতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কাউন্টারে কোনো যাত্রী নেই। হানিফ কাউন্টারের গোলাম মোস্তফা বলেন, অন্য সময়ে শুক্রবার ও শনিবার আগে থেকে টিকেট বুকিং থাকে। তবে গত দুই দিনে আগাম বুকিং যেমন নেই, তেমনি কাউন্টারেও কোনো যাত্রী নেই।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে চেকপোস্ট : যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের পাশাপাশি প্রস্তুত র্যাব। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ভ্রাম্যমাণ চেকপোস্ট বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করে সংস্থাটি। রাজধানীর মতিঝিল, শাপলা চত্বর, ফকিরাপুল, সচিবালয় এবং জিরো পয়েন্টসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় র্যাবের চেকপোস্টে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করতে দেখা গেছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিত টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, স্থান ও প্রবেশ পথসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যাবের চেকপোস্টে নিয়মিত তল্লাশি চলছে। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা রোধে সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে র্যাব। গোয়েন্দা নজরদারি ও নিয়মিত টহল ছাড়াও সংস্থার স্পেশাল ফোর্স, ডগ স্কোয়াড, বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। সাইবার জগতে গুজব ও অপপ্রচার রোধে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হচ্ছে।
কমলাপুর স্টেশনে পুলিশের নিরাপত্তা : কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে এবং ভেতরেও পুলিশের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে শুক্রবার যাত্রীর চাপ অনেক কম বলে জানিয়েছে স্টেশন কর্তৃপক্ষ। কমলাপুর স্টেশনে সরেজমিন দেখা যায়, বাইরে একসঙ্গে বেশি মানুষকে জটলা করতে দিচ্ছে না পুলিশ। কোনো ধরনের দলবদ্ধ অবস্থান থাকলেই তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া স্টেশনের ভেতরে রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ বুথেও পর্যবেক্ষক টিম কাজ করছে।
বিপাকে বিদেশগামী যাত্রীরা : বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে ঢাকা এসে হয়রানির শিকার হয়েছে একাধিক প্রবাসী। এমনই একজন শুক্রবার সকালে খুলনা থেকে মা-বোনকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন সৌদিগামী রাসেল সরকার। ১২ ডিসেম্বর ভোরে তার ফ্লাইট, তবে ট্রাভেল এজেন্সির কাছে জমা তার পাসপোর্ট-টিকেট। সমাবেশ থাকায় ৯ ডিসেম্বর দুপুরের আগেই তাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিজয়নগর এলাকার নাইটিঙ্গেল মোড়ে এসে রাসেল পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাজধানীতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি কেউ করতে না পারে সেজন্য পুলিশের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ ও সাইবার ইউনিট সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সেটিও নজরে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াড ও সোয়াট টিম প্রস্তুত আছে।
Leave a Reply