অনলাইন ডেস্ক: বড় কোনো চমক ছাড়াই গোলাপবাগে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবি ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তারা ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। সমাবেশের আগে সরকারকে আল্টিমেটামের হুমকি দিলেও এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাতজন সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি যুগপৎ আন্দোলনের যে রূপরেখা ঘোষণার কথা নেতারা জানিয়ে আসছিলেন, সেটিও হয়নি। তবে যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালনের কথা জানায় বিএনপি।
জনসভাস্থল নিয়ে নানা নাটকীয়তা আর টানাপড়েন শেষে শনিবার রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ঢাকার সমাবেশ করেছে বিএনপি। নিত্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম কমানো এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ নানা দাবিতে এটিই ছিল তাদের শেষ বিভাগীয় কর্মসূচি। গণসমাবেশে শেষ দিকে ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। দলের মহাসচিবের অবর্তমানে তিনি ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। তিনি জানান, ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে গণমিছিল করবে বিএনপি। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর বিএনপি মহানগরীতে আরও একটি মিছিল করবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যদের মুক্তির দাবিতে।
বিএনপির ১০ দফা দাবিতে যা যা রয়েছে : ১. বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮ খ, গ ও ঘ-এর আলোকে দলনিরপেক্ষ একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। ৩. একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোট নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করতে হবে। ৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী সব মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, সন্ত্রাস দমন আইন-২০০৯ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করতে হবে। ৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, সার, পানিসহ জনসেবা খাতগুলোয় মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। ৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। ৮. গত ১৫ বছরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। ৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার করতে হবে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের উপযোগী করার লক্ষ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, এই সমাবেশ এই বার্তা দিচ্ছে যে, দেশের জনগণ আর প্রতারিত হতে রাজি নয়। তারা এখন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র নেতৃত্ব চায়। সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে। পুলিশ আমাদের পার্টি অফিসে যা করেছে, তাতে নিন্দার ভাষা নেই। অন্যদিকে বিএনপির এমন কর্মসূচিতে তৃণমূল কর্মীরা অনেকটা হতাশ হয়েছেন। সরকার পতনে আরও গরম কর্মসূচি চেয়েছিলেন তারা।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে সমাবেশে আসা যুবদল নেতা চৌধুরী নাজিম উদ্দিন বলেন, এগুলো নরম কর্মসূচি। গরম কথা বলে নরম কর্মসূচি দিলে কাজ হবে না। এক দফা আন্দোলনে যেতে হবে। নইলে সরকারকে ঝাঁকুনি দেওয়া যাবে না। একই কথা বলেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিএনপি নেতা সাত্তার মিয়া।
তিনি বলেন, আমরা রাজপথে আরও বড় কর্মসূচি চেয়েছিলাম। দেখা যাক নেতারা সামনে কী সিদ্ধান্ত নেন। তবে তৃণমূল সরকার পতন আন্দোলনে প্রস্তুত আছে।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, ঢাকায় তারা যে সমাবেশটি করেছেন, সেটি গা গরমের। সামনে ‘শেষ রাজপথের যুদ্ধ’ হবে। আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। আর সেই যুদ্ধে বিএনপি জয়লাভ করবে।
আর জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, বিনাভোটের সংসদে থাকার কোনো মানে হয় না। সরকার যে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন ও বীভৎস লুটপাট চালিয়েছে- এসব কিছুর প্রতিবাদে আমি পদত্যাগ করছি।
যেমন ছিল ঢাকার সমাবেশ : বেলা ১১টা থেকে সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুক্রবার এ সমাবেশ হওয়ার ঘোষণার পর থেকেই গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। রাতের মধ্যেই মাঠটি প্রায় ভরে যায়। তারা শীতের রাত কাটান খোলা আকাশের নিচে। ঢাকার বাইরে উত্তরের জেলাগুলো থেকে লোকজন অংশ নেন সমাবেশে। তারা বেশিরভাগই শুক্রবার রাতে ট্রেনে কমলাপুর আসেন। মাঠের বাইরে আশপাশের এলাকায়ও নেতাকর্মীদের ব্যাপক ভিড় ছিল।
গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। তার নেতৃত্বে সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সমাবেশস্থল ঘিরে সাঁজোয়া যান ও জলকামানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। তবে সমাবেশে প্রবেশ করতে নেতাকর্মীদের বাধা দেয়নি পুলিশ। সমাবেশে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উত্তাপ ছড়িয়ে আসা ১০ ডিসেম্বরের এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে বলে মত বিএনপি ও পুলিশের। সভাপতির বক্তব্যে নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন ঢাকা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান।
Leave a Reply