অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের কারণে এটি হয়েছে। সরকারের মা ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালীন জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় ইলিশ উৎপাদন রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে তাতে আগামী কয়েক বছরে উৎপাদন আরও বাড়বে এবং বিশ্বের প্রায় ৮০-৯০
শতাংশ ইলিশ উৎপাদন দেশ হবে বাংলাদেশ। আমাদের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
ঝালকাঠি : জেলায় জাতীয় সম্পদ ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ২৮০ টন। জেলায় মোট মৎস্য চাষি রয়েছেন ২৫ হাজার ৫৩৭ জন এবং মৎস্যজীবী রয়েছেন ৭ হাজার ৯২৯ জন। বছরের দুটি সময়ে জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধন বিরোধী অভিযানে জেলেরা দীর্ঘদিন বেকার থাকেন। এ সময় তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। এ জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে জাটকা নিধনের সময়ে ৩ হাজার ২০০ জেলেকে ১৬০ কেজি করে ৫১২ টন ভিজিএফ চাল, মা ইলিশ নিধন বিরোধী অভিযোনের সময়ে ৩ হাজার ৮৫০ জন জেলেকে ২৫ কেজি করে ৯৬.২৫০ টন ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমুদ্রগামী ২৪০ জেলেকে ৫ কেজি করে ১৩.৪৪ টন ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়। অপরদিকে এদের প্রণোদনাস্বরূপ ৬৯০ জনকে বকনা বাছুর, ৬৫০ জনকে ছাগল ও ৫৭০ জনকে জাল দেওয়া হয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. রবিউল হোসেন জানান, ঝালকাঠিতে বর্তমানে ইলিশসহ মোট মাছের উৎপাদন রয়েছে ১৬ হাজার ৯৬৫ টন। চাহিদা ১৫ হাজার ২৭০ টন। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত রয়েছে ১ হাজার ৬৯৫ টন।
চাঁদপুর : চাঁদপুরে এক বছরে ৩৪ হাজার ৩২৬ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে মৎস্য সম্পদ সুরক্ষা ও সমৃদ্ধ অর্জনে মৎস্য অধিদফতর কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রম বিষয়ে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলার মাছের চাহিদা ছিল ৬৮ হাজার ৪৬৬ টন। উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০.৬২ টন এবং উদ্বৃত্ত ছিল ৪৭ হাজার ৬২৪.৬২ টন। একই অর্থ বছরে শুধু ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩৪ হাজার ৩২৬ টন।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম এবং শতভাগ ইলিশ উৎপাদনের মধ্যে বাংলাদেশে ৮৬ ভাগ ইলিশ মাছ উৎপাদন হয়। চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশের প্রতি সবার দৃষ্টি থাকে। সম্প্রতি অনলাইনে ইলিশ বিক্রিতে প্রতারণা অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অনেকে ফেসবুকে পেজ খুলে এই সুযোগ নিচ্ছেন। জেলার সুনাম রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমাদের নদীতে শুধু ইলিশই নয়, সব ধরনের মাছের উৎপাদন হয় উল্লেখ করে তিনি জানান, জেলায় নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা হচ্ছে ৪৭ হাজার ২৪৯ জন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে জেলেদের মাঝে বকনা বাছুর ও বৈধ জাল বিতরণ করা হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মেঘনা নদী উপকূলীয় মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় ৫০০ জেলেকে বকনা বাছুর, গ্রুপ করে ২৭৬ জন জেলেকে ৯২টি জাল ও ৩৫০ জন জেলেকে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑচাঁদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শান্ত, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নুর হোসেন, সাংবাদিক আলম পলাশ, ফারুক আহম্মদ, মুহাম্মদ মাসুদ আলম প্রমুখ।
বরিশাল : বরিশালে এক বছরে ৪৭ হাজার ২৫৩ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সভা কক্ষে মৎস্য অধিদফতরের আয়োজনে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম। সভায় আলোচকরা জানান, দেশব্যাপী বরিশালের ইলিশ মাছের আলাদা সুনাম রয়েছে। এবার বরিশাল জেলায় উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ২৯০ টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণের পরিমাণ ৫১ হাজার ৩৩৮ টন। বরিশাল জেলায় মাছের মোট চাহিদা ৫৭ হাজার ৫১৯ টন এবং উদ্বৃত্ত মাছের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৭৭১ টন। এ ছাড়া বরিশালে মোট মৎস্য চাষি ৮৫ হাজার ৫৩৭ জন। যাদের ৯১ হাজার ৯৯৯টি পুকুর (৯৮২২.০ হেক্টর) এবং ৩ হাজার ৭৯২টি খামারে (১৪৫৮.০ হেক্টর) মৎস্য চাষ চলমান আছে। পাশাপাশি এ জেলায় অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ৫০ হাজার ৯৫২ টন।
আলোচকরা আরও বলেন, মৎস্য চাষিদের নিয়ে ২০ থেকে ২৫ সদস্যের গ্রুপ করে পোনা মাছ চাষ ও প্রাথমিকভাবে বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা ও বাকেরগঞ্জের শ্রীমন্ত নদীতে খাঁচায় মাছের চাষ শুরু হয়েছে। আশার কথা, পদ্মার এপারে ২১ জেলার মধ্যে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলায় দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে শিং, মাগুর, কৈ, গুলসা, পাবদার পোনা উৎপাদন ও চাষে নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এসব চাষির মাধ্যমে বরিশাল জেলার অন্যান্য উপজেলায় দেশীয় প্রজাতির মাছের সম্প্রসারণ ঘটবে। আমাদের মূল লক্ষ্য আগামী দিনে বরিশাল জেলায় দেশীয় প্রজাতি মাছ ও উচ্চ ফলনশীল মাছ চাষ সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে গলদা চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ ও কচুরীপানা অপসারণ করে পতিত জলাশয়কে মাছ চাষের আওতায় আনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনদীপ ঘরাই।
ভোলা : ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই সাগরে জাল ট্রলার নিয়ে নেমে পড়েছে জেলেরা। তবে ইলিশ কম পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ সত্ত্বেও মৎস্য অধিদফতর বলছে, তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। ইলিশ ধরার এই মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করছেন ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া পাড়ের জেলেরা। মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠেছে যায় ২৩ জুলাই মধ্যরাত থেকে। এরপর থেকেই পুরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সাগর মোহনার মাছঘাটগুলোর আড়তদাররা। জেলার অন্তত আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ জেলে রয়েছে। যারা ইলিশ মাছের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে ১ লাখ ২৮ হাজার নিবন্ধিত জেলে পাচ্ছেন সরকারি অনুদানের চাল। তারপরও বরাবরের মতো পাওয়া না পাওয়া নিয়ে জেলেদের ক্ষোভ। তাদের অভিযোগ, জেলে না এমন মানুষ চাল পাচ্ছে। তাদের রয়েছে নামে বেনামে জেলে কার্ড।
সাগর মোহনা ঢালচর ও চর আলমের (পূর্বের চর) মো. মনির বলেন, বর্তমানে সাগরে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া নদী উত্তাল থাকায় জেলেরা নদীতে যেতে পারছে না। আশা করছি আরও বেশি ইলিশ পাওয়া যাবে।
ঢালচরের ফরাজী আলম বলেন, নদী এবং সাগরে আগের তুলনায় ইলিশ কমে যাচ্ছে। যা পাচ্ছি তা দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। চরফ্যাশন সাম্রাজ ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মো. আলাউদ্দিন জানান, কিছু ইলিশ ধরা পড়ছে মেঘনা নদীতে। দাম বেশি থাকায় পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তাছাড়া নতুন মোকাম তৈরি হচ্ছে, যেখানে ইলিশ বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছি।
জেলা মৎস্য কর্মকতা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, বছরে ১ লাখ ৯২ হাজার টন ইলিশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের টার্গেট ধরা হয়েছে। আশা করছি আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এই মুহূর্তে যদিও সব জেলে সমানভাবে মাছ পাচ্ছে না। তবে সামনে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে বলে তিনি জানান। সুত্র: সময়ের আলো
Leave a Reply