অনলাইন ডেস্ক: আওয়ামী লীগ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সংস্কার করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই ছিল ১০টি হোন্ডা, ২০টি গুণ্ডা; নির্বাচন ঠাণ্ডা। এই নির্বাচনি সংস্কারও কিন্তু আওয়ামী লীগ, ১৪ দল মহাজোট মিলে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর যেই কাজই করুক আমাদের জেল খাটাক আর যাই করুক, তারা অন্তত সেই প্রস্তাবের কিছু কাজ করে গেছে।
তিনি বলেন, যেমন খালেদা জিয়া ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল, সেটা বাদ দিয়ে ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয়েছে, যাতে কেউ ভুয়া ভোট দিতে না পারে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স অর্থাৎ আগেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরতে না পারে এবং ভোট দিতে গিয়ে যাতে সবাই দেখতে পারে, আওয়ামী লীগেরই স্লোগান ছিল, আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। ভোট দেওয়ার সেই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার সেই অধিকার আওয়ামী লীগই নিশ্চিত করেছে।
শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘পদ্মা সেতু…আমাদের ওপর দুর্নীতির অভিযোগ এসেছিল। দুর্নীতি করে টাকা বানাতে আসিনি।’
‘আমার বাবা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর আমি চার বারের প্রধানমন্ত্রী। আমাদের পরিবার দুর্নীতিই যদি করত, তাহলে দেশের মানুষকে আর কিছু দিতে পারতাম না। আমরা দেশের মানুষকে দিতে এসেছি। মানুষের জন্য করতে এসেছি। এ কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, এটা অত্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে মেনে নিতে পারি না।’
তিনি বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলাদেশ। সব মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে। এই সুযোগটা তৈরি করে তিনি দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য তিনি তা পারেননি। ’৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে এই স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।’ এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। ’৭৫ এর পর মানুষের মুখে হাসি ফোটানো তো দূরের কথা, তারা যেন আবারও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছিল।
পঁচাত্তরের কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডে দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আওয়ামী লীগ এরকম এক কাউন্সিলে আমাকে আমার অবর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমার ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে ফিরে আসতেই হবে। এমন একটা দেশে ফিরে এসেছিলাম, যেখানে আমার পিতার খুনিদের বিচার হবে না বলে ইনডেমনিটি জারি হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা হয়েছিল। সেই রকম একটি দেশে আমার কোনও থাকার জায়গা ছিল না…আমি কিছু চিন্তা করিনি। ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব রেহেনার ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম। একটা কথা স্মরণ করে যে, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে স্বপ্ন আমার পিতা দেখেছিলেন…কাজেই এই স্বাধীনতা যাতে ব্যর্থ না হয়, এই স্বাধীনতার সুফল যাতে বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছায়, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল আমার লক্ষ্য।
তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশ আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে একটি ভোট চুরি করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু কারও ভোট চুরি করলে বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেয় না। এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। তখন গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। বাংলার জনগণ তাকে বাধ্য করেছিল। এরপর ১২ জুনের নির্বাচনে আমরা সরকার গঠন করি। বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছিলাম, স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করেছিলাম, স্কুল-কলেজ রাস্তাঘাট করেছিলাম, যমুনা নদীর ওপর সেতুসহ অনেক কাজ করে দেশকে একটা জায়গায় নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। কেন পারিনি তা অনেকবার বলেছি। কিন্তু বাংলাদেশের এতোটুকু স্বার্থ আমার জীবন থাকতে নষ্ট হবে না, কারও হাতে তুলে দেব না। আমার এই প্রতিজ্ঞাই ছিল। হয়ত এ কারণে আমরা আসতে পারিনি। এতে আমার কোনও আফসোস নেই।
২০০১ যারা ক্ষমতায় এসেছিল, হত্যা-খুন-জঙ্গিবাদ-লুটপাট-দুর্নীতি, বিদ্যুৎ না দিয়ে খাম্বা এরকম অনেক খেলা এদেশের মানুষ দেখেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার বানিয়ে নির্বাচনে কারচুপি করার যে চক্রান্ত করেছিল, সেই চক্রান্তও এদেশে মানুষ নস্যাৎ করে দিয়ে তারপর অবশ্য এমার্জেন্সি আসে। ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এমার্জেন্সি সরকার। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাজোট করে জয়লাভ করি। পরপর তিন বার আমরা ক্ষমতায়। এই ক্ষমতায় থাকায় আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি। যেখানে বাংলাদেশের বাজেট হত মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেট। সেখানে এই অর্থবছরে আওয়ামী লীগ বাজেট দিয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করে, বিশেষ প্রণোদনা দিয়েও আমরা এই বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছি।
আওয়ামী সরকারের সময়ে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা এই কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করেছিলাম। যে দেশে জাতির পিতা এদেশে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশে উন্নীত করেছিলেন। কিন্তু এরপর যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়া সরকার, এরশাদ সরকার অথবা খালেদা জিয়া সরকার কেউ-ই কিন্তু প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগই কিন্তু ৮ শতাংশ পর্যন্ত আমরা তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য আমাদের করোনা কিছুটা হলেও আমাদের সেই অগ্রগতি ব্যাহত করে। এরপরও আমরা গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ আমরা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
‘এখন এসেছে যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা। এতে সারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত ধনী দেশগুলো আজকে অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে। বাংলাদেশ আমরা এখনও আমরা অর্থনীতিতে সচল রাখতে পেরেছি। এরপরও এর আঘাতটা তো আমাদের ওপর আসবে।’
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৩৪ ডলার। আর বিএনপির আমলে তো মাত্র ৩৩৫ ডলার ছিল। আজকে আমাদের সেখানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে পেরেছি। আমরা যে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করেছিলাম ২০১০ থেকে ২০২১ সেটা আমরা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আনতে পেরেছি।’
দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আজকে ৭৪ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ বয়স্ক বিধবা এবং স্বামী নিগৃহীত, তারা ভাতা পাচ্ছেন। যেখানে আমরা খরচ করছি ৯৮১ কোটি ১২ লাখ টাকা। মানুষ যেন কষ্টে না থাকে সেজন্য এই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর বাইরে প্রতিটি প্রতিবন্ধী মানুষকে আমরা ভাতা দিই। আবার তারা শিক্ষার জন্য বিশেষ অনুদানও পায় বৃত্তি পায়, উপবৃত্তি পায়। দুই কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে আমরা কিন্তু বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি করোনার সময়ে তা বন্ধ হয়নি, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এক হাজার টাকা করে প্রণোদনা দিয়েছি প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার জন্য। আমরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী দিচ্ছি। জাতির পিতার ডাকে তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সুতরাং তাদের সম্মান করা…যে যে দলই করুক না কেন, যিনি মুক্তিযোদ্ধা তিনি সম্মানীয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশন গঠন করতে আইন করে দিয়েছি। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করছি। সেখানে সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করে না। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করে দিয়েছি। আগে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক সক্ষমতা নিজস্ব ছিল না, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সেটা রাখা ছিল। সেখান থেকে আর্থিক সক্ষমতা আমরা তাদেরটা তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। বাজেট থেকে সরাসরি তাদের হাতে টাকা দেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের তার সরকারের বৈপ্লবিক অগ্রগতির কথা জানিয়ে দিয়ে শতভাগ বিদ্যুৎ বিতরণের সাফল্যে চিত্র তুলে ধরেন তিনি। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়া আহ্বান জানান তিনি।
জাতির পিতা গৃহহীনদের জন্য ঘর করে দিতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু এ কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তাই ’৯৬ সাল থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা শুরু করেছিলাম ভূমি ও গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার কাজ। আজকে ৩৫ লাখ গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর দিয়েছি।
করোনাকাল থেকে স্বাস্থ্যখাতকে আরও উন্নত করার প্রক্রিয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২২ হাজার চিকিৎসক এবং ৩০ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ৩০ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে দিয়েছি। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে এটা বন্ধ করে দিয়েছিল। এরা তো মানুষের কথা চিন্তা করে না।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে দেশব্যাপী প্রযুক্তিখাতে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
যুদ্ধ-নিষেধাজ্ঞা বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না। ওগুলো বন্ধ করেন। সকল দেশ স্বাধীন সবার স্বাধীনভাবে চলার অধিকার আছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা জানি।’
‘বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আহ্বান করবো, এই যুদ্ধ বন্ধ করেন। তাদের উসকানি দেওয়া বন্ধ করুন। শান্তি চাই।’
Leave a Reply